আবহাওয়া , অপরূপ সমুদ্রসৈকতের টানে লক্ষ লক্ষ বাঙালি সারা বছর ধরে পুরী বেড়াতে আসে। পুরী হলো বাঙালির আবেগের জাযেগা। বাঙালি হয়ে সারাজীবন একবার পুরী যায়নি এটা আজ অকল্পনীয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে খুব কম সময় বা রাতারাতি পৌঁছনো যায় বলেও হয়তো পুরী বাঙালির পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। জগন্নাথের রথযাত্রা উপলক্ষে অনেক বাঙালী হয়তো ইতিমধ্যে পুরী পৌঁছেছেন বা অনেকে পৌঁছবেন
কিন্তু কলকাতা থেকে পুরীর ট্রেন সংযোগের পিছনে রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর জাহাজডুবি এবং ৭৮০ জনের মৃত্যুর এক করুণ ইতিহাস।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের আর পাঁচটা তীর্থস্থানের মতো পুরীধামেও লোকে পদব্রজে যাতায়াত করত। সে পথ ছিল যেমন বিপদসংকুল তেমনি দুর্গম । লেগে যেত বেশ কয়েক মাস। পথে ছিল ডাকাত, মহামারী, বন্যার ভয়। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এই পরিস্থিতির তেমন নড়চড় হয়নি।প্রচুর তীর্থযাত্রী পথে মারা যেত। এই পথকে বলা হতো "জগন্নাথ সড়ক'' উনিশ শতকের মাঝামাঝি একবার ''মার্শমান '' এবং ''স্টিফেনসন'' দুই ব্রিটিশ প্রোমোটার কলকাতা ও পুরীর মধ্যে রেলরোড তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কোনো কারণে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৮৭০ সাল নাগাদ সরকারি হিসেব অনুসারে প্রায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ যাত্রী পুরী যাচ্ছিলো। ক্রমেই তাই হিন্দুদের মধ্যে জোরালো হতে থাকে পুরী পর্যন্ত একটি ট্রেনলাইন স্থাপনের দাবি। কিন্তু ব্রিটিশ প্রভুদের কাছে সেই দাবি ধোপে টেকেনি।
এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে কিছু প্রাইভেট স্টীমার কোম্পানি। তারা তাদের ছোট বাষ্পীয় জাহাজে কলকাতা থেকে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যেত চাঁদবালি অবধি। সেখান থেকে তারা পালকি করে কটক হয়ে পুরী পৌঁছতো। কিন্তু টিকিটের দাম ছিল আকাশছোয়া , তাই এই জলপথ ছিল নিম্নমধ্যবিত্তের ধরাছোয়ার বাইরে। একমাত্ৰ জমিদার এবং বাবুশ্রেনী লোকেদের মা, বিধবা বোন. বৌ দের জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। বর্তমানে কলকাতার ছটুলাল ঘাট থেকে ছাড়তো এই স্টিমারগুলি।
এই রকম এক ছোট স্টীমার ছিল ''ম্যাকলিন এন্ড কং '' এর '' স্যার জন লরেন্স''।১৮৮৭ সাল। তারিখটা ২৫ শে মে। ঘূর্ণিঝড়ের মরসুম। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে কিছু বছর আগে বিধ্বংসী ''আয়লা'' ঐদিনই পশ্চিমবাংলার বুকে আছড়ে পরে।প্রায় ৭৫০ যাত্রী এবং ৩০ জন নাবিক নিয়ে ''স্যার জন লরেন্স '' চাঁদবালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগ মহিলা। নাবিকদের মধ্যে মাত্র ছয়জন ইংরেজ ছিল। যাই হোক সেই দিন এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের পর এই স্টিমারের সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করা যায়নি। এতো যাত্রী , নাবিক লস্কর নিয়ে যেন কপূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। অনেকটা আজকের দিনে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ৩৭০ এর মতো ঘটনা। কোথায় গেলো এই জাহাজ? কোনো বিপদে পড়লো না তো? শুরু হলো জোর তল্লাশি। কিন্তু কোথাও এই জাহাজের খোঁজ মিললো না। এই ভাবে দুইদিন কেটে যাওয়ার পর অন্য কিছু জাহাজ থেকে খবর এলো যে তারা গঙ্গার মোহনায় একটি জাহাজের কিছু ভাঙ্গা অংশ এবং প্রচুর লাশ ভেসে যেতে দেখেছে।
এরপর সরকার তদন্ত চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলো যে '' ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলা স্যার জন লরেন্স জাহাজটির সলিলসমাধি হয়েছে এবং আরোহী এবং নাবিকদের প্রত্যেকেই এই জাহাজডুবিতে নিহত হয়েছে''। নিহত যাত্রীদের তালিকায় কিছু ইংরেজ মহিলাও ছিলেন।এই ঘটনার কিছুদিন পর কিছু ইংরেজ মহিলা এই জাহাজডুবিতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে বর্তমান ছোটুলাল ঘটে বাংলা এবং ইংলিশে একটি ফলক স্থাপন করেন। যাতে লেখা আছে
'' ইং ১৮৮৭ সালের ২৫ এ মে তারিখের ঝটিকাবত্ত সার জন লারেন্স বাস্পীয় জাহাজের সহিত যে সকল তীর্থযাত্রি (আধিকাংশ স্ত্রীলোক) জলমগ্ন হইয়াছেন তাহাদিগের স্মরণার্থ কয়েকটি ইংরাজ রমণী কর্ত্তক এই প্রস্তর ফলক খানি উৎসীগৃত হইল।''
এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায় তৎকালীন ভদ্রলোক বাবু সমাজে ।যেহেতু নিহতদের বেশিরভাগ সমাজের এই অংশের মহিলা ছিলেন তাই শিক্ষিত কলকাতার বাবুরা এই ঘটনার সূত্র ধরে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের তুলোধোনা করতে লাগলো।কিছুদিন আগে সমাপ্ত হওয়া দার্জিলিং হিমালয়ান রেললাইনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলা হতে লাগলো যে ভারতে ব্রিটিশেরা রেললাইন তৈরী করছে শুধু নিজেদের সুবিধা এবং আমোদ প্রমোদের জন্য।সাধারণ ভারতবাসীদের জন্য ব্রিটিশদের কোনো হেলদোল নেই। পুরী পর্যন্ত রেল সংযোগ থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তারা এও বলতে লাগলো যে যদি ব্রিটিশ সরকার এই মুহূর্তে পুরীকে রেল মাধ্যমে যুক্ত করার ঘোষণা করে তাহলে ভারতের ১৬ কোটি হিন্দু ব্রিটিশ সরকারের এই দানকে চিরদিন মনে রাখবে।
শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের চাপের কাছে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করে এবং কলকাতা থেকে কটক হয়ে পুরী পর্যন্ত রেল লাইন পাতার কাজ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৯ সালে কলকাতা থেকে পুরীর রেলপথ জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।কিন্তু ওড়িশার কিছু বড় নদীর উপর ব্রিজ তৈরির কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ার জন্য ১৯০০ সালের আগে কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে পুরী পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
আজ যখুন গঙ্গার ওপারে হাওড়া স্টেশন থেকে একের পর এক সুপারফাস্ট ট্রেন একদল যাত্রীকে নিয়ে পুরী রওনা দিচ্ছে তখন গঙ্গার ঠিক এপারে ছোটুলাল বাবুর ঘাটের এক প্রান্তে অবহেলায় ক্রমশ মলিন হচ্ছে এই প্রস্তর স্মৃতি ফলক। যাদের স্মৃতিতে এটা বানানো তারাও একদিন ছিল পুরীযাত্রী। কিন্তু ভাগ্যের করুন পরিহাসে তাদের আর পৌঁছনো হয়ে ওঠেনি।কিন্তু সেই ৭৮০ টা প্রাণ আমাদের দিয়ে গেছে পুরী পর্যন্ত এক আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আত্মবিস্মৃত বাঙালী আজ সেই ইতিহাস মনে রাখেনি।
তথ্যসূত্র : Wreck of Sir John Lawrence,The advent of Kolkata - Puri rail link by Rangan Dutta
:Shipwreck that got the Railways to Odisha, The Pioneer, Bhubaneswar
ছবি : নিজস্ব।প্রাচীন স্টিমারের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত।
Complete link
click here